মহানবি মোহাম্মদ (সা) এর জিবনি পর্ব-২

  


গতপর্বে,,,, 
আরবের চিরাচরিত প্রথা অনুসারে রাসুল (সা) এর জন্মের ৭ম দিনে কুরাইশ সরদার আব্দুল মুত্তালিব তার পিত্রিহীন নাতীর আকিকার ভোজে অংশ গ্রহনের জন্য  সবাইকে দাওয়াত করেন । খাওয়া দাওয়া শেষে আগত মেহমানরা নবজাতকের নাম জিজ্ঞেস করলে আব্দুল মুত্তালিব হরসৎফুল্য চিত্তে উত্তর করলেন মুহাম্মদ । সমাবেত স্বজনরা আশ্রুতপুর্ব ব্যতিক্রমি নাম  শুনে বললেন , এমন নাম তোহ আর কখনো শুনিনি ।
পর্ব-২
 যুগ যুগ ধরে স্বগোত্রে প্রচলিত সব নাম পরিত্যক পুর্বক আপনি এক ব্যতিক্রমি নাম রাখলেন । স্বজনদের আপত্তি পূর্ণ জিজ্ঞাসার জবাবে বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিব বলেন " আমার একান্ত কাম্য এই সন্তান যুগ যুগে পৃথিবীর সর্বত্র প্রশংসিত হোক । তাই আমি তার এই নাম করন করেছি " । হজরত আমেনা গরভাবস্থায় সপ্ন দেখেন কে যেন বলছে '' তোমার সন্তানের নাম রাখবে আহমদ  '' ।উল্লেখিত উভয় নামই তার বাল্য কাল থেকে প্রচলিত ছিল এবং পবিত্র কুরানে কারিমেও ৪ জায়গায় মুহাম্মদ এবং শুধু ১ জায়গায় আহমদ নাম ব্যবহৃত হয়েছে । পূর্ববর্তি আসমানি কিতাবেও রাসুল (সা)  সম্পর্কিত যে ভবিষ্যৎ বানী করা হয়েছে , তাতেও মুহাম্মদ এবং আহমদ নাম দুইটি ব্যবহৃত হয়েছে । 
 বাইবেল পুরাতন নিয়মের ওল্ড টেস্টামেন্ট এ মুহাম্মদ নাম আজও বিদ্যমান । সোলায়মানের পরমসঙ্গি , ৫ম অধ্যায়ে ১০ থেকে ১৬ পদের অনুবাদে নানা প্রকার অসামাঞ্জস্য থাকলেও , মূল হিব্রু ভাষায় বাইবেলে উদ্রিত মুহাম্মদিস  আজও স্পষ্ট অক্ষরে বিদ্যমান রয়েছে ।
 আরবি ও হিব্রু ভাষায় মুহাম্মদ শব্দের মূল ধাতুগত রুপ " হা মিম দাল " । হিব্রু ভাষায় "ইয়া" ও "মিম"প্রযুক্ত হয়েছে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ।  বাইবেলের নতুন নিয়মে নিউ টেস্টামেন্টে আহমদ নামটি ছিল ।


পরবর্তীতে পরাক্লিত শব্দ দ্বারা আহমদ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে  । অতএব , দ্বিধাহীন চিত্তে বলা চলে , এই নামকরণের পিছনেও কুদ্রতের হাত কার্য্যকর ছিল । নবজাতকদের লালন-পালন ও স্তন্য দানের ভার ধাত্রীদের উপর ন্যস্তকরনের প্রথা অবস্থা পুর্ণ ভদ্র আরব পরিবারগুলোর মাঝে সাধারন ভাবে প্রচলিত ছিল । 

 ভদ্র অবস্থাপন্ন সদ্বংশজাত ঘরের রমণীরা নিজেদের সন্তানদের লালন-পালন ও স্তন্যদানের ব্যাপারটা অগৌরবের মনে করত । নিকটবর্তী  পল্লি এলাকার বেদুইন গোত্রের মহিলারা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে নিয়ে যেতো । শিশুর অভিভাবক এজন্য ধাত্রীকে যথার্থ উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করত । ভদ্র অবস্থাসম্পন্ন আরব সমাজে বহুকাল পর্যন্ত এই প্রথা প্রচলিত ছিল । এমনকি উমাইয়া রাজ পরিবারের দুগ্ধপোষ্য শিশুরা বেদুইন আরব গোত্রের ধাত্রীদের নিকট প্রেরিত হয়ে তথাই প্রতিপালিত হত । তাই পল্লি এলাকার নির্মল আলো-বাতাস ও নির্ভেজাল ভাষার বিপুল প্রভাব তাদের জীবনে পরিলক্ষিত হত ।  একমাত্র ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকই তার কোনো কারণবশত রাজপ্রাসাদে প্রতিপালিত হন । এ কারণে তার আরবি সাহিত্যের জ্ঞান অপূর্ণই থেকে যায় । সারকথা, আট বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থাপন্ন ও ভদ্র পরিবারের সন্তানরা বেদুইন মহিলাদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হত । 
রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে স্থাপন করেছিলেন । কথিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর জন্ম সংবাদ ছোয়াইবাই প্রথম আবু লাহাবকে দিয়েছিলেন । ফলে আবু লাহাব ছোয়াইবাকে তাৎক্ষনাথ মুক্ত করে দেয় । অবশ্য এর বিপরীত মতও রয়েছে ।  রাসূলুল্লাহ (সা) ছোয়াইবাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে আবু লাহাব হতে খরিদ করার বহু চেষ্টা করেও সফল হন নাই । উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষন রাসূলুল্লাহ (সা) এর অন্যতম চারিত্রিক ভাষণ । যেকোনো কারণে তার সামান্য উপকারও কেও করলে , তিনি চিরকাল তা স্মরণ রেখে প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করতেন । ছোয়াইবার ক্ষেত্রেও তার বিপরীত কিছু হয় নাই । অল্প সময়ের জন্য ছোয়াইবা তাকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন তাই চিরকাল তিনি ছোয়াইবাকে  অত্যন্ত শ্রদ্ধা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখতেন । ছোয়াইবার পরে তিনি আরো দুজন মহিলার স্তন্যপান করেন বলে কেউ কেউ বলেছেন করেছিলেন । ছোয়াইবার দুধ পান করেছিলেন মাত্র আট দিন । রাসূল (সা) এর জন্ম গ্রহণের পর পূর্ব প্রচলিত প্রথা বসত  বেদুইন গোত্রের মহিলারা দুগ্ধপোষ্য  শিশুদের নেওয়ার জন্য মক্কা শরীফে আগমন করে । অনাবৃষ্টি জনিত কারনে সেই বছর আরবে দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছিল । আগত ধাত্রী মহিলারা প্রথমত পিতৃহীন শিশু মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি বিশেষ একটা খেয়াল করে নাই । কারণ,  একটাই  আগত ধাত্রী মহিলাদের ভাবনা পিতৃহীন এই শিশুকে প্রতিপালন করে খুব একটা পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে না । 
 আগত প্রত্যেকেই সচ্ছল পরিবারের পিতা-মাতা জীবিত আছেন , এমন দুগ্ধপোষ্য শিশু নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে । কিন্তু ভাগ্যবতী হালিমার ভাগ্যে এতিম শিশু মুহাম্মদ (সা)ই জুটলেন । দেরিতে আসার কারণে অন্য কোনো সন্তান জুটে নাই । তিনি পিতৃ্শিশু মুহাম্মদ (সা) এর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন । জন্মের এক মাসের মাথায় ,হালিমা তার  লালন-পালনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন । ধাত্রী হজরত হালিমা ছিলেন আরবের হাওয়াজেন গোত্রের শাখা গোত্র এক বনি সাদের এক ভাগ্যবতী রমণী । বিশুদ্ধ আরবী ভাষা হিসেবে বনি সাদ গোত্র আরবের সর্বত্রই খ্যাতি অর্জন করেছিল । ঐতিহাসিক  বারখার্ডদি এমন কতগুলো আরব বেদুইন গোত্রের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা ধাত্রী পেশায়  নিয়োজিত ছিল ।বারখার্ডদির উল্লিখিত গোত্র গুলোর মধ্যে বনি সাদের নামও রয়েছে ।
 এক্ষেত্রে একটু চিন্তা করলে রাসূল (সা) হালিমার প্রতিপালনে অর্পিত হওয়া একটি বিশেষ মোজেজাবলি পতিত হয় । কেননা অনেক ধাত্রী মহিলাই তোহ দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য এসেছিল , তাদের কারোরই আব্দুল্লাহর এতিম , আমেনার পিতৃহীন দুলালের প্রতি দৃষ্টি না পড়া এবং অন্য কোনো শিশু জুটাতে না পারার মধ্যে একটা রহস্যময় যোগসূত্র রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় । রাসূল (সা) এর ধাত্রী হজরত হালিমার পিতার নাম আবু জুয়ায়ব । স্বামীর নাম  হারেস । হালিমার এক পূত্র   আব্দুল্লাহ   এবং আনিসা   , হুজাইফা ও    হুজাফা নামের ৩ কন্যার জননী ছিলেন । হুজাইফা সাইমা নামে খ্যতি লাভ করেন । তিনি রাসূল (সা) এর লালন-পালনে তার মাকে সাহায্য করেছেন বলে ঐতিহাসিক দের কেউ প্রকাশ করেছেন । হযরত হালিমা ও তার স্বামী  রাসূলুল্লাহ (সা) এর জিবন্দশায়েই ইসলাম গ্রহণ করেন । তবে বিবি হালিমার স্বামী হারেসের  ইসলাম গ্রহণের সময় কাল সম্পর্কে চরিতকারকদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয় । হালিমার পূত্র আব্দুল্লাহ এবং কন্য হুজাইফা সাইমাও ইসলাম গ্রহণ করেছেন । আনিসা ও হুজাইফার  ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি । 
এযাত্রায় রাসূল (সা) দুই বছর বিবি হালিমার স্তন্যপান করেন । দুই বছর পর দুধ ছারিয়ে হালিম তাকে হযরত আমিনার নিকট নিয়ে আসেন । তার অপরুপ দেহকান্তি , নাবন্ন্যপয় চেহারা দর্শনে আত্মীয়স্বজন সবাই বিশেষত হযরত আমিনা খুবই প্রিত হন । সন্তানের প্রতি তাকিয়ে তার চোখ জুড়িয়ে যায় । এসময় মক্কা শরীফের আবহাওয়া সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দূষিত হয়ে পড়ে । সুতরাং তিনি পুনরায় প্রাণের নির্ভিকে প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে ধাত্রী হযরত হালিমার দায়িত্বে অর্পণ করেন । ভাগ্যবতী হালিমা আনন্দের সাথে তাকে নিজ গৃহে নিয়ে যান । অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে তাকে  হজরত আমেনাকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসতেন । এভাবে পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি বিবি হালিমার গৃহে থাকেন । এসময় তিনি হযরত হালিমার সন্তান তার , তার দুধভাই ও দুধভগ্নিদের  সাথে ছাগল-মেষ চরানোর জন্য মাঠে যেতেন । মাঠে গিয়ে কখনো কখনো উচ্চ পর্বতে আরোহণ করতেন ।   আবার কখনো অপলক দৃষ্টিতে দূর পানে চেয়ে থাকতেন । হযরত হালিমা তার এই সময়কার আচরণ ও হাব-ভাব সম্পর্কে বলেন , "আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি উঠাবসা কথাবার্তা মৌনতা এককথায় মোহাম্মদের শৈশবের প্রতিটি কাজেই একটা অসাধারণ মহত্ত্বের ভাব সত্যই ফুটে উঠত" । হালিমার সন্তানরা তাকে সহদর ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন । তার বয়স যখন ছয় বছরে  উপনীত হয় , তখন কথিত বক্ষবিদারণ এর ঘটনায় ভীত হয়ে , ধাত্রী হযরত হালিমার তাকে মক্কায় আমেনার কাছে রেখে যান। খাতেমুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) পিতৃ অরস থেকে মাতৃ যোঠের অবস্থান গ্রহণের দুই মাস পরেই হযরত আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন । হযরত আব্দুল্লাহর ইন্তেকাল সম্পর্কে চরিতকারকগণ  বলেন " তিনি এক কাফেলার সাথে সামদেশে গমন করেন । ফেরার পথে কাফেলা যখন ইয়াস্রে পৌঁছে তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তাই তিনি তার মাতুলবংশ বনি নাজ্জারে  থেকে যান " । বাণিজ্য কাফেলা মক্কা শরীফ পৌঁছলে আবদুল মুত্তালিব এর পুত্র আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন । কাফেলার লোকেরা তার অসুস্থতা এবং মদিনায় মাতুলালয় অবস্থানের সংবাদ দেয় । এই সংবাদ পেয়ে আব্দুল মোক্তালেব তার বড় ছেলে হারেসকে আব্দুল্লার  অসুস্থতাজনিত খোঁজখবর নেওয়ার জন্য মদিনায় মদিনায় পাঠায় ।হারেস মদিনায় পৌঁছে জানতে পারেন আব্দুল্লাহ মাসাধিককাল রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করেছেন । হারেস এসে যখন এই হৃদয়বিদারক দুঃখজনক সংবাদ দেন তখন আব্দুল মোত্তালেব স্বয়ং এবং সমগ্র বনি হাশিম খুবই মুসলে পরেন । কেননা তিনি বাবা এবং ভাইদের অনেক আদরের ছিলেন । সারকথা, জন্মের পূর্বে রাসূল (সা) পিতাকে হারিয়ে এতিম হন । সুতরাং, তার এতিম হয়ে ইহজাগতিক উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতে প্রতিপালিত এবং সমগ্র বিশ্বের নেতৃপদে বরিত  হওয়ার কাহিনী মোজেজাপুর্ণ ভঙ্গিতে কুরআনের সূরা দুহায় আলোচিত হয়েছে । আল্লাহ তায়ালা এরসাদ করেন , 
"তিনি কি আপনাকে এতিম রূপে পাননি? অত:পর আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথহারা, অত:পর পথ প্রদর্শন করেছেন। আপনাকে পেয়েছেন নি:স্ব, অত:পর অভাবমুক্ত করেছেন। সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। " (সূরা দুহা : ৬-৯)। 
রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর ছয় বছর বয়সকালে মা আমেনাও ইন্তেকাল করেন । মা আমেনাকে সঙ্গী করে মদীনায় বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন । প্রত্যাবর্তনের পথে আবহাওয়া নামক স্থানে এসে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং কিছুদিন রোগভোগ করে এখানেই ইন্তেকাল করেন । তিনি দাসি উম্মে আইমান এর সাথে মক্কা শরীফেদাদা স্নেহের ক্ররে প্রত্যাবর্তন করেন । আম্মার ইন্তেকালের পর তার লালন-পালনের দায়িত্ব আপনা থেকেই দাদা আবদুল মুত্তালিব এর উপর এসে যায় । আট বছর বয়সে দাদা আবদুল মুত্তালিবও এই অস্থায়ী জগত থেকে চিরস্থায়ী জগতের পথে পাড়ি জমান । 






No comments

Powered by Blogger.